Monday, September 15, 2025

ডাকসু ভোটের যোগফলে গরমিল প্রকাশিত সংশোধিত ফলে যা মিলল

আরও পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ফল প্রকাশের দুই দিন পর গত শনিবার প্রকাশ করা হয় হলভিত্তিক কেন্দ্রের ফল। এতে ঘোষিত ফলাফলের সঙ্গে প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের যোগফল না মেলার অভিযোগ তোলেন বেশ কয়েকজন প্রার্থী।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকেই। তবে এই গরমিলকে ‘বিরতিহীন কর্মসম্পাদনজনিত মানবীয় অবসাদের কারণে কয়েকটি ক্ষেত্রে ভুল’ উল্লেখ করে গতকাল রোববার রাতে সংশোধিত ফল প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।

ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয় গত ৯ সেপ্টেম্বর। পরদিন সকালে আনুষ্ঠানিক ফল প্রকাশ করা হয়। এ নির্বাচনে শিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের অধিকাংশ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এতে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন আবু সাদিক কায়েম, জিএস পদে জয় পান একই প্যানেলের এস এম ফরহাদ এবং এজিএস নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন খান।

ভোটগ্রহণের দিনই অনেক প্রার্থী ভোট কারচুপির অভিযোগ তোলেন। ফলাফল ঘোষণার পর যারা বিজয়ী হতে পারেননি তারাসহ কেউ কেউ এ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। সর্বশেষ হলভিত্তিক ফল প্রকাশের পর যোগফলে গরমিল নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। তবে এসব গরমিল উঠে আসার পর যাচাই-বাছাই করে ফের সংশোধিত ফল প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।

গতকাল রাত ১০টার দিকে সংশোধিত ফল প্রকাশ করার পর গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান ডাকসুর প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক জসীম উদ্দিন। এতে বলা হয়, ডাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষিত ও প্রকাশিত ফলাফল চূড়ান্ত ও অপরিবর্তিত আছে। ৮টি কেন্দ্রের ভোট যোগ করে ডাকসুর সমন্বিত ফলাফল তৈরির সময় দীর্ঘ বিরতিহীন কর্মসম্পাদনজনিত মানবীয় অবসাদের কারণে সামান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে যোগবিভ্রাট ঘটে। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ইতোমধ্যে প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের ভিত্তিতে ডাকসুর সমন্বিত ফলাফল সংশোধিত হয়েছে। এই সংশোধনীর কারণে নির্বাচিতদের তালিকায় কোনো পরিবর্তন হয়নি।

আরও পড়ুনঃ  ফেব্রুয়ারির কত তারিখে হতে পারে নির্বাচন, জানাবেন প্রধান উপদেষ্টা

যাদের ভোট কম দেখানো হয়েছিল: ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে বিজয়ী আসিফ আব্দুল্লাহর প্রকৃত ভোট ৯ হাজার ১০১ হলেও ফলাফলে ৪০ ভোট কমিয়ে ৯ হাজার ৬১ ভোট দেখানো হয়। একই পদে মো. আসিফ জারদারীর ভোট ২ হাজার ৫০ হলেও ফলাফলে তা ২ হাজার দেখানো হয়।

ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে নির্বাচিত মাজহারুল ইসলামের ৫০০ ভোট কম দেখানো হয়। তার ১৮টি হল মিলিয়ে ভোট ৯ হাজার ৮৪৪ হলেও ফলাফলে ৯ হাজার ৩৪৪ ভোট দেখানো হয়। ক্রীড়া সম্পাদক পদে ছাত্রদলের প্যানেলের চিম চিম্যা চাকমার প্রাপ্তভোট ৩ হাজার ৮৮৮ হলেও ফলাফলে ১০০ ভোট কমিয়ে ৩ হাজার ৭৮৮টি দেখানো হয়।

সদস্য পদে সর্বমিত্র চাকমার ভোট ৯ হাজার ৫৪৮ হলেও ফলাফলে ৫৬০ ভোট কমিয়ে ৮ হাজার ৯৮৮ দেখানো হয়। সদস্য পদে আবিদ আব্দুল্লাহ পান ২ হাজার ৪২৩ ভোট; কিন্তু ৪০টি ভোট কমিয়ে দেখানো হয় ২ হাজার ৩৮৩টি। সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক পদে মো. লানজু খানের প্রকৃত ভোট ১ হাজার ৫৭১ হলেও ফলাফলে ১ হাজার ৫৩১ ভোট দেখানো হয়। আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে মোহাম্মদ সাকিবের ৩ হাজার ৯৬২ ভোটকে দেখানো হয় ৩ হাজার ৯২২ ভোট। একই পদে আতাউর রহমান অপুর ভোট তিনটি কমিয়ে প্রকাশ করা হয়। তিনি ৫৯৮ ভোট পেলেও দেখানো হয় ৫৯৫ ভোট।

যাদের ভোট বেশি দেখানো হয়েছিল: ভিপি পদে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ মোট ৬টি ভোট পেলেও ৮টি ভোট দেখানো হয়। সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে আশরেফা খাতুন প্রকৃতপক্ষে ৮৯০ ভোট পেলেও ফলাফলে ৯০০ ভোট দেখানো হয়। সমাজসেবা সম্পাদক পদে তাওহিদুল ইসলামের এক ভোট বেশি দেখিয়ে ২ হাজার ৪৪ ভোটকে ২ হাজার ৪৫ হিসেবে গণনা করা হয়েছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ফাতিন ইশরাক ভোট পান ২ হাজার ১১টি। তবে ১০ ভোট বাড়িয়ে ২০২১ ভোট উল্লেখ করা হয়েছিল। একই পদে ফারহান লাবিবের ভোট ৪৮৬ হলেও ৪০ ভোট বাড়িয়ে দেখানো হয় ৫২৬টি। ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে মাহাথির খান নিনাদ ও মো. রায়হানের ভোট যথাক্রমে ৬৯৪ ও ৩০৫ হলেও ১০টি করে বাড়িয়ে ফলাফলে ৭০৪ ও ৩১৫ দেখানো হয়। সদস্য পদে আবির হাসানের ভোট ৩ হাজার ২২৬ হলেও দেখানো হয় ৩ হাজার ৩২৬। আর মনির হোসেন ৫৪৬টি ভোট পেলেও ফলাফলে দেখানো হয় ৫৮২টি

আরও পড়ুনঃ  ইস*রাইলের যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হা*মলা

গরমিলের বিষয়টি তুলে ধরে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক প্রার্থী মোহাম্মদ সাকিব তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘হল থেকে প্রাপ্ত ভোটের লিস্ট অনুযায়ী আমার মোট ভোটসংখ্যা ৩৯৬২; কিন্তু সম্মিলিত লিস্ট এবং রেজাল্টের লিস্টে ভোটসংখ্যা ৩৯২২। শিক্ষার্থীদের রায়কে সম্মান জানিয়ে যে কয়জন নির্বাচনকে গ্রহণ করেছে আমি তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলাম। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ব্যর্থতাকে আমি দালিলিক প্রমাণ হিসেবে রাখলাম।’

নির্বাচনের ফলাফলে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত চৌধুরী। তিনি অভিযোগপত্রে ফলাফলে অসংগতি, দায়িত্বপ্রাপ্তদের পক্ষপাতিত্ব, প্রক্সি ভোট, আগেই ভরাটকৃত ব্যালট পেপার, অস্বাভাবিক ভোটার উপস্থিতি এবং আচরণবিধি লঙ্ঘনের মতো সুনির্দিষ্ট কিছু অনিয়মের কথা উল্লেখ করেন। ভোট প্রদানের সংখ্যা, পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা এবং প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশেরও দাবি জানান আরাফাত চৌধুরী।

ভোট গ্রহণ ও গণনার সব প্রক্রিয়ার ভিডিও ধারণ: ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম, কারচুপি হয়নি বরং সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের। তারা বলেন, ভোটগ্রহণ এবং গণনার প্রতিটি ধাপ ধারাবাহিকভাবে ভিডিওতে ধারণ করা হয়েছে। এ উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। ভিডিও ধারণের আওতায় অন্তর্ভুক্ত ছিল—ভোটকেন্দ্র খোলার পূর্ব প্রস্তুতি, ব্যালট বাক্স সিলগালা করার আগে খালি বাক্স উপস্থিত সাংবাদিকদের দেখানো, ব্যালট বাক্স সিলকরণ এবং নির্বাচন সামগ্রী প্রস্তুত; ভোট প্রদান প্রক্রিয়া, যেখানে ভোটারদের উপস্থিতি, পরিচয় যাচাই, ব্যালট বিতরণ ও ভোট প্রদানের ধাপগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল; ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট বাক্স ফের সিলগালা ও নিরাপদে সংরক্ষণ; ভোট গণনার সময় ব্যালট বাক্স খোলা, এজেন্ট ও পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ; ব্যালট শ্রেণিবিন্যাস, ওএমআর মেশিনে স্ক্যানিং এবং ইলেকট্রনিক রেকর্ড তৈরি; ভোট গণনার সফটওয়্যারের মাধ্যমে ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ, আউটপুট যাচাই এবং চূড়ান্ত ফল প্রকাশ। পুরো প্রক্রিয়াটির ভিডিওচিত্র সিসিটিভি ক্যামেরা ও নির্ধারিত ভিডিওগ্রাফি দলের মাধ্যমে ধারণ ও সংরক্ষণ করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

আরও পড়ুনঃ  বেতন নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পাচ্ছেন বড় সুখবর

ভিপি পদে ১০০ ভোটের কম পেয়েছেন ৪৪ জনের ৩৭ জনই: ডাকসুর এবারের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৪৫ জন ভিপি পদে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় স্থান পান। অবশ্য পরে নানা অভিযোগে জুলিয়াস সিজার তালুকদারের প্রার্থিতা বাতিল হয়। ৪৪ জন নির্বাচনে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৩৭ জন প্রার্থী পেয়েছেন ১০০ ভোটেরও কম। ৫০ ভোটের কম পেয়েছেন ৩৫ জন। এ ছাড়া ১০ ভোটের কম পেয়েছেন ২৩ জন প্রার্থী। এর মধ্যে তিনজন পেয়েছেন সর্বনিম্ন ১ ভোট করে। তারা হলেন—রাকিবুল ইসলাম, সুজন হোসেন ও রাসেল হক।

অন্যদিকে, জিএস প্রার্থী ছিলেন ২৩ জন। তাদের মধ্যে ১০০ ভোটের কম পেয়েছেন ১০ জন। সর্বনিম্ন ৬ ভোট পেয়েছেন নিয়াজ মাখদুম এবং ৯ ভোট পেয়েছেন সাইয়াদুল বাশার।

কম ভোট পাওয়া প্রার্থীদের অনেকেই বলছেন, তারা শুধু শখের বশেই ভিপি, জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। অনেকে আবার নিজের ভোটও নিজেকে না দিয়ে দিয়েছেন পছন্দের প্রার্থীকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেউ কেউ শুধু পরিচিতি পেতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। এ কারণে আগামীতে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা নীতিমালায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ